বিনা স্বদেশী ভাষা, পুরে কি আশা?
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২৭ আগস্ট, ২০১৪, ১২:৪০:১৬ দুপুর
সবে মাস্টার্সের রেজাল্ট বের হয়েছে। কোথায়ও তখন পর্যন্ত গোলামীর জিঞ্জির পড়ে যাওয়া-আসা শুরু করিনি। পেপারে জব অফারগুলো দেখে দেখে কল্পনায় বিচরণ করছিলাম। এই সময় আব্বা আমাকে বসে না থেকে, ভুঁইয়া একাডেমিতে স্পোকেন ইংলিশ এবং কম্পিউটার লার্নিং এর মাল্টিপল মেম্বারশীপ করে সেখানে সময় কাটাতে পাঠালেন। সময় তখন ১৯৯৮ ইং।
একদিন আব্বার এক বন্ধুর পরিচিত এক আমদানিকারক আমাদের চিটাগং এর হালিশহরের বাসায় বেড়াতে এলেন। তিনি বিদেশ থেকে কেমিকেল আমদানি করেন। চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে ওনার কিছু কাজও ছিল। আব্বার পোষ্টিং তখন সেখানে। ইতোমধ্যে আব্বার সেই বন্ধুর ছেলে একটি সি এন্ড এফ লাইসেন্স করে কাজ শুরু করেছে। সেও তখন আমাদের বাসায়। ঐ আমদানিকারকের মাল খালাসের দায়িত্ব নিয়েছে আব্বার বন্ধুর সেই ছেলে।
একদিন আমাকে সহ ওনারা দু'জন চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজে গেলেন। ওনাদের মালামাল খালাসের ব্যাপারে কি এক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আমি এমনিতে গেলাম। যাহোক, সেই আমদানিকারক, সি এন্ড এফ এর মালিক এবং আমি- এই তিনজন সহকারী কমিশনার (কাস্টমস) এর কক্ষে প্রবেশ করলাম। সেখানে ঢুকেই সেই আমদানিকারক সহকারী কমিশনারের সাথে চোস্ত ইংরেজীতে কথা বলা শুরু করলেন। সহকারী কমিশনার আমদানিকারকের কথা চুপচাপ শুনে গেলেন। এরপর বললেন, ' আপনি মনে হয় ইংরেজী একটু বেশী ভালো জানেন। এখানে কি কোথায়ও লেখা আছে, বাংলায় কথা বলা নিষেধ?' আমি এবং আব্বার বন্ধুর সেই ছেলে, দুজনেই লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলাম। আমদানিকারকের মুখে আর কোনো কথা জোগালো না। তিনি সম্পর্কে আমাদের দুজনের আঙ্কেল হন। তাই আমরা লজ্জাটা একটু বেশী পেয়েছিলাম।
এই প্রসঙ্গটা এই জন্য আজ লিখলাম, আমি প্রায় সময়ই দেখি, অনেকে শুধুমাত্র নিজেকে অতি আধুনিক প্রমাণ করার জন্য পরিচয় হবার সাথে সাথেই ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করেন। আমি একেবারে ইংরেজী কম বুঝি। তাই আমার খুব অসুবিধে হয়... কিছুটা বিব্রতও হই। আর আমার আশেপাশে যারা থাকেন তারাও আমার বিব্রত অবস্থা দেখে কষ্ট পান। প্রয়োজন ছাড়া বাংলা ভাষাভাষীদের সাথে ইংরেজী বলার দরকারটা-ই বা কি? আমার বাসায় একজন শিক্ষক আমার ছোট ভাইকে পড়াতে আসতেন। তিনি আমাকে দেখলেই সব সময় চোস্ত ইংরেজীতে কথা বলা শুরু করতেন। এজন্য আমি তিনি যে সময়টা বাসায় পড়াতেন, আমি পারলে সেই সময় বাইরে থেকে কাটিয়ে আসতাম।
আমার এই পোষ্টের উদ্দেশ্য, ইংরেজী বিরোধিতা নয়। তবে নিজেদের ভিতর কথা বার্তা বলার সময় কেন এই মানষিকতা? ফেব্রুয়ারী মাস এলেই একেবারে বাংলা বাংলা করে জান দিয়ে ফেলি, অথচ একজন বাঙালি (ভাষার দিক দিয়ে, জাতি হিসেবে এখন বাংলাদেশী) হয়েও অন্য একজন বাঙালির সাথে কথাবার্তায় কেন এই ইংরেজি প্রীতি?
কেউ কেউ আবার আমাদের এক সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর মত, ' উই আর লুকিং ফর শত্রুজ' জাতীয় কথা বার্তা বলে থাকেন। এগুলোও পরিহার করা উচিত। আমাদের বাংলা কত মিষ্টি ভাষা! এই ভাষায় রচিত হয়েছে কত কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস। নিজেদের মায়ের ভাষাকে যদি সত্যিই হৃদয় দিয়ে ভালোবাসতাম, তবে এইভাবে কথাবার্তায় নিজেকে জাহির করতে ফট করে ইংরেজীতে কথা বলা শুরু করতাম না; কিংবা বাংলা মাধ্যম স্কুল বাদ দিয়ে নিজ সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যম এর স্কুলগুলোতে যে কোনো ভাবেই হোক ভর্তি করানোতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতাম না। কেউ আমার লেখায় ইংরেজী মাধ্যম স্কুলগুলো খারাপ বা নেতিবাচক, ভেবে বসলে ভুল করবেন। আমি এখানে গুরুত্ব কিংবা অগ্রাধিকারের বিষয়টি তুলে ধরতে চাইছি।
নিজ দেশের ভাষা, সংস্কৃতি আজ বিজাতীয় ভাষা-সংষ্কৃতির নীচে চাপা পড়ে আছে। খুব দুঃখ লাগে যখন নিজের সন্তান ভিডিও গেমস খেলার জন্য পটপট করে গেমসগুলোর নাম বলে, এর ভিতরে একটিও দেশী গেমসকে খুঁজে পাই না! বিনোদনের জন্য দেশীয় চ্যানেলগুলো অবহেলিত থেকে যায়। মেয়েরা আমার হিন্দী চ্যানেলগুলোতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে; কারণ তাঁরা জন্মের পরে দেখে এসেছে, বাবা-মা এগুলোই দেখছে। নিজের মেয়ে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারছে কি পারছে না, সেটা না দেখে যখন সে ইংরেজী বা হিন্দিতে সাবলীল ভাবে কথা বলে, নিজের মনে কি একটুও আনন্দ লাগে না? কার্টুন চ্যানেলগুলোতে দিনভর আমার মেয়ে বিচরণ করে, এর ভিতরে কোনটি বাংলায় ডাবিং করা? মিনা ছাড়া তেমন মানসম্মত বাংলা কার্টুন কি আমাদের বাংলা চ্যানেলগুলো প্রচার করতে পারছে?
খুব দুঃখ হয় আসলে। দিন দিন অবস্থার আরো অবনতি হচ্ছে। এই অবস্থার অবসান হওয়া দরকার। কিন্তু কীভাবে হবে জানি না।।
বিষয়: বিবিধ
১৬৯২ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ইংরেজী প্রাকটিস করার জন্য পারস্পরিক বলা-বলি মেনে নেয়া যায়। তবে নিজেকে অনেক বড় ও বেশী কাবিল দেখানোর জন্য যত্র তত্র প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ইংরেজী বলার কী দরকার। ধন্যবাদ।
আমার বাসায় একজন শিক্ষক আমার ছোট ভাইকে পড়াতে আসতেন। তিনি আমাকে দেখলেই সব সময় চোস্ত ইংরেজীতে কথা বলা শুরু করতেন। এজন্য আমি তিনি যে সময়টা বাসায় পড়াতেন, আমি পারলে সেই সময় বাইরে থেকে কাটিয়ে আসতাম। আমার মতে প্রক্টিসের জন্যই তিনি এমনটি করতেন।
আপনি কি চট্টগ্রামের লোক? কোথায় থাকেন আপনি? আমারও জন্ম পড়াশুনা এবং কর্মস্থল চট্টগ্রাম শহরেই।
আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ। অনেক ভাষা জানা ভালো । তবে ভাষা প্রয়োগের স্থান , কাল ও পাত্র ভেদ জানা বিজ্ঞের কাজ। শুভেচ্ছা রইলো আপনার জন্য। ভালো থাকবেন।
উত্তর হল রক্ষকেরাই ভক্ষক। আর্থাৎ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য শাসকেরা এসব কর্মকান্ডকে সহায়তা করে যান। মানুষকে বোঝান বিদেশিদের দাসত্বেই মুক্তি। তাই এসব বলে আসলে আমাদের কোন লাভ নেই। এভাবেই চলতে থাকবে আর আপনি হতাশা প্রকাশ করে যাব। তবে ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট বলে একটা কথা আছে সেটার দিকেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি কিন্তু টার্নিং পয়েন্ট কখনো শান্তিপূর্ণ হয়না। এটাই বাস্তবতা।
আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। এবং শুভেচ্ছা রইলো।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো। ভালো থাকবেন।
আপনার মন্তব্য আমাকে মুগ্ধ করলো আবারো।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা ভাই। @ঘুম ভাঙ্গাতে চাই
আমার এক শ্যালিকা চিটাগং মাস্টার মাইন্ড থেকে ও-লেভেল কমপ্লিট করেছে। সে ঠিকমত বাঙ্গলায় লিখতে পারেনা। বাঙ্গলা লিখে আমার মত ভাষা ভাষা ইংরেজীর মত। আমি চট্টগ্রাম সি ডি এ আ/এলাকার একটি ইংরেজী মাধ্যমের স্কুলে (প্লে-স্কুল) আমার শ্যলিকাকে ২০০১ ইং সালে নিয়ে যেত-স্কুল)সেখানের শিশুদেরকে খেলার সময়েও নিজেদের ভিতরে ইংরেজীতে কথা বলতে শুনেছি, ওদের স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনা পর্যন্তও বাঙ্গলার সংস্রব বিহীন হয়ে যাচ্ছিল। এরা নিজের মাতৃভাষাকে প্রকারান্তরে অবহেলার শিক্ষাই কিন্তু পেয়ে যাচ্ছিল।
আমার উদ্দেশ্য ছিল আমাদের বাঙ্গলা ভাষাকে সর্বাগ্রে রেখে এরপর অন্য ভাষার গুরুত্ব বহন করায়। আপনি ভারতের কথা উল্লেখ করেছেন, সেখানে ইংরেজী কিন্তু সেকেন্ড ল্যাঙ্গোয়েজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, আমাদের দেশে?? আর ভারতীয়দের ভিতরে হিন্দীর গুরুত্ব কিন্তু আগে, এরপর ইংরেজী। আপনি লিখেছেন, "আমাদের গৌরবের মাতৃভাষাও ঠিকমতো জানিনা। বিভিন্ন সাইনবোর্ডে, প্রচারমাধ্যমে ভুল বানানের ছড়াছড়ি দেখলে এমন মনে হয়।"- এইজন্যই তো বাংলার প্রতি গুরুত্ব বেশী দিতে হবে।
আপনার সাথে একটু তর্ক করলাম, আনন্দও পেলাম আপনার মত পাঠকের সাথে এটা করতে গিয়ে।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো আপনার জন্য।
ভালো থাকবেন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন